শুরু করেছেন কী শাওয়ালের ছয় রোজা?

পবিত্র রমজান বিদায়ের পর এলো মহামান্বিত শাওয়াল মাস। মুমিন বান্দার নিকট এ মাসের গুরুত্বও অপরিসীম। রমজানের পর মানুষ যেনো রোজার কথা ভুলে গিয়ে উদাসীন না হয়ে যায়, এজন্য আল্লাহ তায়ালা এ মাসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ছয়টি রোজা দান করেছেন। রমজানের ফরজ রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের এ ছয় রোজা রাখা মুস্তাহাব। হাদিসে এ রোজার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুলে আকরাম (সা.) নিজে এ রোজা রাখতেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণকেও রাখার জন্য নির্দেশ দিতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যারা মাহে রমজানের ফরজ রোজা রাখার পর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবে, তারা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব অর্জন করবে।’ (মুসলিম শরিফ: ১/৩৬৯) এ রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ বলেন, ‘যারা পবিত্র রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়ালের আরো ছয়টি রোজা রাখবে, তারা সেই ব্যক্তির মত হয়ে যাবে যে ব্যক্তি সদ্য তার মায়ের পেঠ থেকে দুনিয়াতে আগমণ করেছে।’ (তিরমিজি: ৪৩৪৫)

অর্থাৎ সে শিশু যেমন পুত-পবিত্র ও নিষ্পাপ, তার কোন গোনাহ নেই; যারা শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবে তারাও সেই নিষ্পাপ শিশুর মত হয়ে যাবে। হজরত উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কি সারা বছর রোজা রাখতে পারবো?’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে। কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখো এবং রমজান পরবর্তী মাস শাওয়ালের ছয় রোজা রাখো। তাহলেই তুমি সারা বছর রোজা রাখার সওয়া পাবে।’ (তিরমিজি শরিফ: ১৫৭৩)

এ হাদিসে বলা হয়েছে যে, রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যাবে। এই সওয়াব এভাবে হবে, মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের সুরা আনআমের ১৬০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘যে একটি নেক কাজ আঞ্জাম দিবে সে দশগুণ বেশি সওয়াব পাবে।’ সে হিসেবে রমজানের ত্রিশ রোজায় তিনশত রোজার সওয়াব হয়। আর শাওয়ালের ছয় রোজায় ষাট রোজার সওয়াব হয়। সুতরাং রমজানের ৩০ রোজা এবং শাওয়ালের ৬ রোজা মোট ৩৬ রোজা দশ দিয়ে গুণ দিলে ৩৬০ রোজার সমান হয়ে যায়, আর ৩৬০ দিনে এক বছর। সুতরাং ৩৬ টি রোজায় সারা রছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।

শাওয়ালের রোজা রাখার নিয়ম: শাওয়ালের ছয় রোজা শাওয়াল মাসেই শুরু করে শেষ করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে ছয় দিনে ছয় রোজা রাখলেও হবে আবার মাঝে ফাঁকা রেখে পৃথকভাবেও রাখা যাবে। উল্লেখ্য যে, শাওয়ালের ছয় রোজার সওয়াব কেবল তারাই পাবে, যারা রমজানের রোজা সঠিকভাবে পালন করেছে। কারণ রমজানের রোজা হচ্ছে ফরজ আর শাওয়ালের রোজা মুস্তাহাব। আর মুস্তাহাবের সওয়াব তখনই পাওয়া যায় যখন ফরজ যথাযথভাবে পালন করা হয়। অনেককে দেখা যায়, রমজানের রোজা ঠিকমতো পালন না করে শাওয়ালের ছয় রোজার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে। এটা মোটেই উচিৎ নয়।

শাওয়ালের এ ছয়টি রোজা নিয়ে আমাদের সমাজে ভ্রান্ত কিছু ধারণা ও কুসংস্কার দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করে, এ ছয় রোজা শুধু মহিলারা রাখবে; বুড়ো ও পুরুষলোক রাখবে না। আবার কেউ কেউ মনে করে, এ রোজা একবার রাখলে প্রতি বছরই রাখতে হবে। এছাড়াও আরো বেশ কিছু কুসংস্কার সমাজে দেখা যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি শরিয়তে এহেন কোন বিধান আরোপ করেনি। এসব কিছুই কুসংস্কার ও কুপ্রথা তথা ভ্রান্ত বিশ্বাস। শাওয়ালের রোজা পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধসহ সকলেই রাখতে পারবে। আবার একবছর রেখে অন্যবছর না রাখলেও চলবে।

শাওয়ালের ছয় রোজা : কখন, কীভাবে রাখবেন?

বিধান : শাওয়াল মাসে পালনীয় ছয় রোজার ক্ষেত্রে বিধান কী? এগুলো কী ধারাবাহিভাবে রাখা জরুরি, নাকি বিরতি দিয়েও রাখতে পারবে? কখন থেকে রোজা পালন করা শুরু করতে হবে এবং কখন শেষ করতে হবে? এর নিয়ত কী হবে? এছাড়া অনেকেই প্রশ্ন করেন— রমজান মাস শেষ হলে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা একসাথে ধারাবাহিকভাবে আদায় করে নেওয়া জরুরি নাকি ভিন্ন-ভিন্নভাবে আদায় করলেও হবে? আমি এ সাওমগুলো তিন দফায় রাখতে চাই। সপ্তাহান্তের ছুটির দুই দিনে সাওমগুলো আদায় করলে আমার জন্য সুবিধা হয় -এমন বিভিন্ন বিষয়াবলী নিয়ে আমাদের সমাজে নানা বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। মূলত মানুষের কাছে থেকে শুনে আমল করার ফলেই এ জাতীয় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অথচ ইসলাম বলেছে, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা ফরজ।

কখন, কীভাবে রাখতে হবে : শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা পালন করা নিয়ে যারা এমন নানা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন, তাদের অবগতির জন্যে বলা যাচ্ছে, শাওয়াল মাসের ছয়টি সাওম ধারাবাহিকভাবে একসাথে রাখা জরুরি নয়। ধারাবাহিকভাবে একসাথে বা ভিন্ন-ভিন্নভাবে- উভয়ভাবেই এই ছয়টি রোজা আদায় করা যায় বা যাবে। তবে জরুরি মনে রাখার বিষয় হলো- শাওয়াল মাসের এই রোজাগুলো যত দ্রুত আদায় করা যায় ততোই কল্যাণ। কারণ, পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে— তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা করো এবং তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাতের প্রতি। হজরত মূসা (আ.) বলেছেন— হে আমার রব, আমি তাড়াতাড়ি করে আপনার নিকট এসেছি, যাতে আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হন। আর দেরি করাটা খোদ একটি সমস্যা ও আপদ।

তবে দ্রুত আদায় না করলেও কোনো সমস্যা নেই। দ্রুত আদায় করতে গিয়ে সঠিকভাবে রোজা পালনে যেন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। যদি কেউ শাওয়াল মাসের মাঝখানে অথবা শেষের দিকে ছয়টি রোজা আদায় করে; তবুও কোনো অসুবিধা হবে না।

আল্লামা ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন— আমাদের মাজহাবের বিজ্ঞ আলেমদের বক্তব্য হলো, শাওয়াল মাসের ছয়টি সাওম আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিস তা প্রমাণ করে। তারা আরো বলেছেন, শাওয়াল মাসের সাওমগুলো ধারাবাহিকভাবে একসাথে মাসের শুরুতে আদায় করাও মুস্তাহাব। যদি ভিন্ন-ভিন্নভাবে রাখা হয় অথবা শাওয়াল মাস চলে যাওয়ার পরে রাখা হয়, তবুও তা জায়েজ হবে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো ইখতিলাফ নেই। ইমাম আহমদ ও দাউদের বক্তব্য এটাই। [আল মাজমু শারহুল মুহাযযাব]

ইমাম নববীর উল্লেখিত আলোচনাটি সঠিক, তবে শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকার স্বার্থে দ্রুত শাওয়াল মাসের শুরুর দিকেই ছয়টি রোজা আদায় করা উত্তম।

রমজানের কাজা আগে নাকি শাওয়ালের রোজা আগে : যে বা যার ওপর রমজান মাসের ফরজ রোজা কাজা আছে, সে বা তারা সবার আগে তার কাজা রোজা আদায় করবে। তারপর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা পালনে ব্রতী হবে। কারণ রাসূল (সা.) বলেছেন— যে রমজানের রোজা রাখবে অর্থাৎ পুরোপুরিভাবে রমজান মাসের রোজা পালন সমাপ্ত করবে। সুতরাং যদি কারো রমজান মাসের রোজা কাজা হয়ে থাকে, তবে সেই কাজা আদায় না করা পর্যন্ত রমজান মাসের রোজা পালনকে সমাপ্ত বা শেষ বলা যাবে না। [আল-মুগনি : ৪/৪৪০] তাছাড়া ইসলামি শরীয়তের বিধান হলো- ওয়াজিব বা ফরজ আমল আদায়ের দায়িত্ব পালন নফল বা মুস্তাহাব আদায়ের দায়িত্ব পালনের চেয়ে অধিক গুরুত্ব রাখে। [হাল ইয়াশতারিতু আত-তাতাবুয়ু ফি সিয়ামিস সিত্তি মিন শাউয়াল, সালেহ আল-মুনাজ্জিদ]