শবে বরাত = বাড়াবাড়ি যেমন , ছাড়াছাড়ি ও তেমন

লাইলাতুল বারাআত ও শবে বরাত; আলাদা ভাষার শব্দ।‘ লাইলাতুল বারাআত’ শব্দদুটি আরবি, যার অর্থ হলো মুক্তির রাত। আবার ‘শবে বরাত’ শব্দদুটি ফার্সি ভাষায় ব্যবহৃত, এর অর্থ দাড়ায় ভাগ্য রজনী। আর হাদিসের পরিভাষায় বহুল পরিচিত ‘ভাগ্য রজনী’কে বলা হয়, ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত।

হিজরি সন গণনায় আগামী ১ মে দিবাগত রাতই ১৪ শাবান। আর এ রাতেই মুসলিম উম্মাহ ইবাদত বন্দেগিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখবে। হাদিসে এ রাতের ফজলিত, মর্যাদা ও করণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন শাবান মাসের অর্ধেক হয়ে যায়, যখন ১৪ তারিখ দিনের পর রাতে আগমন ঘটে, তখন তোমরা সেই রাতে জাগরণ কর আর পরের দিন রোজা রাখ।’ (ইবনে মাজাহ)

শবে বরাত বিষয়ে হাদিসে এসেছে হজরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবি করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫, আল মুজামুল কাবীর ২০/১০৯, শুআবুল ইমান, হদিস নং. ৬৬২৮)

হজরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর তার পিতার সনদে দাদা হযরত আবুবকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সকল পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও মুশহিন (হিংসুক) ব্যতিত। (বায়হাকি ফি শুয়াবিল ঈমান হা. ৩৮৩৫)

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.), আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), আবু মুসা আশআরী (রা.) আবু হুরায়রা (রা.), আবুবকর (রা.),আউফ ইবনে মালিক (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা) সকলেই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসবিশারদগণ উক্ত হাদিসের রাবীদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহীহ’। (সহী ইবনে হিব্বান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২ খণ্ড:পৃঃ ১১৮, মাজমাউল ফাওয়ায়ীদ খণ্ড ৮,পৃ. ৬৫, মুসনাদে বাযযার,খণ্ড ৮.পৃ. ৬৭)

 

শবে বরাত নিয়ে বর্তমান সময়ে বহু বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি চলছে। বাড়াবাড়ির মাত্রা যেমন খুব বেশি, তেমনি ছাড়াছাড়ির অবহেলাও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অথচ ইসলামে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কোনো স্থান নেই। আর ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো প্রত্যেক কাজের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা।

মুসলিম উম্মাহ মধ্যমপন্থা অবলম্বরেন কথা ভুলে গিয়ে শবে বরাত নিয়ে বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়েছে। যা কোনোভাবেই কামন্য নয়। এর ফলে শবে বরাত নিয়ে শুরু হয়েছে অসংখ্য ফেতনা। এ সব বাড়াবাড়ি ও অবহেলার ফেতনা থেকে মুক্ত থাকা সবার জন্যই একান্ত জরুরি।

শবে বরাত ছাড়াও এ মাস হলো রমজানের রোজার রাখার জন্য নিজেদের তৈরির মাস। কেননা এ মাসে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধারে রোজা রেখেছেন। আবার শাবান মাসের মধ্য রজনীতে যেমন ইবাদতের কথা বলেছেন, ঠিক তেমনি পরের দিন রোজা পালনের কথাও বলেছেন।

হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তাআলা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। বান্দার খুব কাছের আসমানে এসে মানুষকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, তোমাদের মধ্যে কেউ পাপী আছ? যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থন করবে, আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।

তোমাদের কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী আছে? যে আমার কাছে রিজিক চাইবে, আমি তাকে রিজিক দান করব।রোগ-শোক, অসুস্থতায় আছে কেউ, যে আমার কাছে রোগ মুক্তি কামনা করবে, আমি তাকে রোগ থেকে মুক্তি দান করব।

এভাবে আহ্বান করতে থাকবে আর তা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও মুক্তি চাইতে বলবে, যে বান্দা ওই রাতে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আহ্বান করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে রাতে কাঙ্ক্ষিত জিনিস দান করবেন। আর তা চলতে থাকবে সুবহে সাদেক পর্যন্ত ‘

অতিরঞ্জিত কর্মকাণ্ড ছাড়াও শাবান মাসজুড়ে ইবাদত-বন্দেগির রয়েছে অনেক বিশেষ বিশেষ কাজ ও ফজিলত। তাছাড়া মধ্য শাবান ইয়াওমে বিজের রোজার অন্তর্ভূক্ত। সে হিসেবেও তা মর্যাদা ও সম্মানের দাবি রাখে।

তবে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে
অনেকে এ রাতকে ঘিরে প্রচণ্ড রকম বাড়াবাড়ির আশ্রয় নেয়। হালুয়া-রুটি, আতশবাজি, আলোকশজ্জা, সন্ধ্যা রাতে রুসুম-রেওয়াজ, হৈ-হুল্লুড় ও পাড়ায় মহল্লায় ঘোরাঘুরির আয়োজন করে আবার সন্ধ্যা রাতে পাপ মোচনের নিয়তে গোসল করাসহ ইত্যাদি বাড়াবাড়ি করে থাকে। যা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’-এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

পরিশেষে…
‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’-এ প্রিয়নবি ঘোষিত আমলগুলো যথাযথ আদায় করা জরুরি। বান্দার জন্য হাদিসের ওপর যথযথ আমলই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে সহায়ক হবে।

সুতরাং শবে বরাতের নামে বাড়াবাড়ি ও অবহেলা না করে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত পন্থায় মধ্য শাবানের রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজির রাখার পাশাপাশি পরদিন রোজা রাখার মাধ্যমে হাদিসের ওপর আমল করাই উত্তম।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ব্যতিত প্রিয়নবির ঘোষণায় মধ্য শাবানের রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ তাআলা ঘোষিত ক্ষমা লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

শবে বরাতের ফজিলত কি ভিত্তিহীন?

মাহফুয আহমদ: আজকাল আমাদের কোনো কোনো বন্ধু কারও কারও কথা শুনে কিংবা কিছু কিছু লেখা দেখে সংশয়ে পড়েন যে, আদৌ পনেরো শাবানের রাত্রির কোনো ফজিলত বা বিশেষত্ব আছে কি না। বাস্তব কথা হলো, শাবানের পুরো মাসটাই ফজিলতপূর্ণ এবং বরকতময়। নবীজি (সা.) এ মাসের বরকত কামনা করে দোয়া করতেন। রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এই মাসে তিনি বেশি বেশি রোজা রাখতেন। হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) রমজান ছাড়া কখনও পূর্ণ কোনো মাস রোজা রাখতে আমি দেখিনি। আর শাবান মাসে তিনি যেভাবে অধিকহারে রোজা রাখতেন, বৎসরের অন্য কোনো মাসে এমনটা করতেন না।’ (সহিহ বোখারি: ১৬৮৬, সহিহ মুসলিম: ১৯৫৬) হজরত উসামা ইবনে জায়দ (রা.) নবীজিকে শাবান মাসে অধিক রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষ এ মাসের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন একটি মাস; যখন আল্লাহ তায়ালার নিকট বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। অতএব আমি চাই,আমার আমলনামা এমন অবস্থায় পেশ করা হোক; যখন আমি রোজাদার।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২১৭৫৩, নাসায়ি: ২৩৫৭)

এরকম নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতকে এই মাসের একটি রাত সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তখন দোয়া কবুল হয়। হজরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)

আজকাল আমাদের যে সকল বন্ধু এ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করে চলছেন, তারা যেসব মনীষীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকেন; তাদের সেই সব বরেণ্য আলেমও কিন্তু পনেরো শাবানের রাত্রির ফজিলত আছে বলে স্বীকার করেছেন এবং এ সংক্রান্ত হাদিস গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকজনের উদ্ধৃতি পেশ করা হলো:

১. শায়খুল ইসলাম হাফিজ ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক ‘মারফ’ হাদিস এবং সাহাবিদের ‘আসার’ বা উক্তি বর্ণিত হয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালিহিনের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাজের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহিহ হাদিসসমূই রয়েছে। কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফজিলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলি ও অহাম্বলি অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফজিলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ (রহ.) এর মতও তা-ই। কেননা এর ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবি ও তাবিয়ি) এর উক্তিও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদিসের কিতাবে (বরং কতক ‘সহিহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহিহ ইবনে খুযায়মা, সহিহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে) রয়েছে।’ (দেখুন: ইকতিজাউস সিরাতিল মুসতাকিম, ২/৬৩১, মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ, এ বিষয়ে তার আরো উক্তি জানতে দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া, ৩/১৩১-১৩২)

২. মুহাদ্দিস আবদুর রাহমান মুবারকপুরি রহ. (মৃ. ১৩৫৩ হি.) বলেন, ‘শাবানের পনেরো তারিখের রাত্রির ফজিলতের ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে; যেগুলোর সমষ্টি থেকে বুঝা যায় যে, এর একটা ভিত্তি রয়েছে।’ তিনি এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, ‘যারা এ রাতের ফজিলত ভিত্তিহীন বলে মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে এসব হাদিস অকাট্য দলিল।’ (দেখুন: তুহফাতুল আহওয়াজি শারহু সুনানিত তিরমিজি, ৩/৪৪১-৪৪২, দারুল ফিকর, বয়রুত,১৩৯৯ হি.)

৩. বর্তমান সময়ের আমাদের সালাফি বন্ধুগণের নন্দিত মুহাদ্দিস, মরহুম শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৪২০ হি.) পনেরো শাবানের রাত্রির ফজিলত বিষয়ক একটি হাদিস সম্পর্কে ‘সহিহ হাদিস’ বলে মন্তব্য করেছেন। (দেখুন: সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা, ৩/১৩৫, হাদিস: ১১৪৪, শাবাকা)