একনজরে কিছু জরুরি জাকাত

দোকান বা বাড়ি ভাড়ার অ্যাডভান্সের জাকাত : দোকান বা বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময় ভাড়াটিয়া মালিককে অ্যাডভান্স হিসেবে মোটা অংকের টাকাও দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে এ টাকা যতদিন দোকান বা বাড়ির মালিকের কাছে থাকবে ততদিন এর জাকাত কে দেবে। মালিক না ভাড়াটিয়া? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- অ্যাডভান্স সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক. অগ্রিম ভাড়া, যা চুক্তিমতে কিছু কিছু করে ভাড়া হিসেবে কর্তন হয়। দুই. ফেরতযোগ্য জামানত। যা ভাড়া হিসেবে কর্তন হয় না। মালিকের কাছে টাকাটা জমা থাকে। বাড়ি বা দোকান ছেড়ে দিলে ভাড়াটিয়াকে সে টাকা ফেরত দেয়া হয়। প্রথম ধরনের অর্থাৎ অগ্রিম ভাড়া হিসেবে যে টাকা দোকান বা বাড়ির মালিক নিয়ে থাকেন সে টাকার তো তিনি সম্পূর্ণ মালিকই হয়ে যান। সুতরাং এরকম অগ্রিম ভাড়ার জাকাত তিনিই দেবেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ধরনের অর্থাৎ ফেরতযোগ্য জামানত বন্ধকের মতো হলেও বর্তমানে দোকান ও বাড়ির মালিকরা নিজের কাজে ব্যহারের জন্যই এ টাকা অ্যাডভান্স হিসেবে নিয়ে থাকেন। ব্যবহার করেও থাকেন। ভাড়াটিয়ার পক্ষ থেকে একটা মৌন সমর্থনও থাকে। বিষয়টি একটি প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাই বন্ধকের বিধান এখানে প্রযোজ্য না হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। দোকান ও বাড়ির মালিকই এ টাকার জাকাত দেবেন। একালের অনেক মুফতি এ ধরনর ফেরতযোগ্য জামানতকে বাইয়ে ওয়াকা প্রতিশ্র“তিমূলক বিক্রির সঙ্গে তুলনা করেছেন এ ধরনের বিক্রির মাধ্যমে বিক্রেতার হাতে যে টাকা আসে তা বন্ধকের পর্যায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মাশায়েখের মতে বিক্রেতার ওপরই এ টাকার জাকাত দেয়া ফরজ হবে।

প্রভিডেন্ড ফান্ডের জাকাত : সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ডে যে টাকা জমা হয় তা দু’ধরনের। একটা অংশ হচ্ছে সেই টাকা যা তাদের বেতন থেকে নিয়মতান্ত্রিক কেটে নেয়া হয়। আর আরেকটা অংশ হচ্ছে চাকরি শেষে অবসর গ্রহণের সময় মূল সঞ্চিত অর্থের ওপর যে বর্ধিত অর্থ প্রদান করা হয়। প্রতিমাসে বেতন থেকে যে নির্ধারিত অংকের টাকা কেটে রেখে প্রভিডেন্ড ফান্ডে সঞ্চয় করা হয় তা চাকরিজীবীর পারিশ্রমিক বটে। কিন্তু চাকরিতে থাকা অবস্থায় যেহেতু এ টাকায় আর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না, টাকা তার আয়ত্বে আসে না সেহেতু এ টাকার জাকাতও তাকে দিতে হবে না। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময় যখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা হাতে আসবে তখন থেকে তিনি এর জাকাত দেবেন। হজরত মুফতি শফীসহ আরও অনেক মুফতিরাই এ ফতওয়াই দিয়েছেন। আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চয়কৃত মূল টাকার ওপর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময় যে বর্ধিত অর্থ প্রদান করা হয় তা মুফতিদের বিবেচনায় পুরস্কারস্বরূপ। চাকরি থাকা অবস্থায় যেহেতু সে পুরস্কার হাতেই আসে না সেহেতু তার জাকাত দেয়ারও প্রশ্নই ওঠে না।

প্লট বা ফ্ল্যাটের জাকাত : নিজে থাকার জন্য যে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হয় অথবা বাড়ি বানিয়ে নিজে বসবাস করার জন্য যে প্লট ক্রয় করা হয় তার জাকাত দিতে হবে না। আর বিক্রির নিয়তে ব্যবসায়িক মানসিকতায় যে প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয় করা হয় বছরান্তে তার বাজার দরের ওপর জাকাত ফরজ হবে। যেমন কেউ বিক্রির নিয়তে ব্যবসায়িক মানসিকতায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে একটি প্লট বা ফ্ল্যাট কিনলেন। বছর শেষে তার বাজার দর হল ১৫ লাখ টাকা। তা হলে তিনি ১৫ লাখ টাকার জাকাত দেবেন। অনেকেই জমি বা প্লট ক্রয় করার সময় কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ত করেন না। জমি বা প্লট বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করবেন নাকি জমিতে বাড়িঘর করে নিজে বা বংশধররা বসবাস করবেন কোনোটারই নিয়ত করেন না। এ ধরনের জমি বা প্লট ব্যবসার জন্য হওয়াটা নিশ্চিত নয় বলে এর জাকাত দিতে হবে না।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ির জাকাত দিতে হবে কি না? : ব্যবসার নিয়তে যে বাড়ি নির্মাণ করা হয় না এবং ভাড়া দিয়ে মাসিক আয়ের উদ্দেশ্যে যেসব বাড়ি নির্মাণ করা হয় এ ধরনের প্রয়োজনোতিরিক্ত বাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা পাওয়া যাবে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। তদ্রুপ যে জমি ব্যবসার জন্য নয় তারও মূল মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। যদি তা ভাড়া দেয়া হয় তাহলে ভাড়ার টাকার ওপর জাকাত আসবে।

শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের জাকাত : কলকারখানায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কাঁচামাল ক্রয় করা হয়। যা ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করা হয়। এসব কাঁচামাল পণ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত ক্রয় মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে। আর যখন এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে কোনো পণ্য উৎপাদন করা হবে তখন তার বাজার দরের ওপর জাকাত ফরজ হবে। এ ক্ষেত্রে কাঁচামাল যেহেতু সরাসরি ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ক্রয় করা হয়নি বরং ব্যবসায়িক পণ্য উৎপাদনের জন্য ক্রয় করা হয়েছে তাই তার বাজার দর নয় ক্রয় মূল্য হিসেবে করা হয়। আর উৎপাদিত পণ্য যেহেতু সরাসরি ব্যবসায়িক পণ্য সেহেতু তার বাজার দর হিসাব করা হয়।

শিল্প কারখানার মেশিনারিজ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির জাকাত : শিল্প কারখানায় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য কোটি কোটি টাকা মূল্যের মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়। কলকারখানার পণ্য পরিবহন বা অন্য যে কোনো প্রয়োজনের জন্য মূল্যবান জাহাজ গাড়ি বাস ট্রাক ইত্যাদি বাহন থাকে এসব মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি বা গাড়ি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কেনা হয় না বরং ব্যবসার মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই এসবের মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। বরং কারখানার উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্যের ওপর অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ওপর জাকাত ফরজ হবে। বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসসহ অন্যসব মেশিনারিজের একই বিধান। ডেকোরেটরে হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট, গ্লাস ইত্যাদি আসবাবপত্র যা বিক্রির জন্য নয় ভাড়ায় খাটিয়ে মুনাফা অর্জনের জন্য কেনা হয় সেগুলোরও একই বিধান। এগুলোর মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। ব্যবসার লাভের ওপর নিয়মতান্ত্রিকভাবে জাকাত ফরজ হবে। রেন্ট-এ কারের জন্য যেসব গাড়ি ও পরিবহন ব্যবহার হয় তারও মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। রেন্ট-এ কার ব্যবসার মাধ্যমে যে মুনাফা অর্জন হবে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। হ্যাঁ যারা সরাসির গাড়ির ব্যবসা করেন অথবা শিল্প কারখানার মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতির ব্যবসা করেন তাদের ক্ষেত্রে গাড়ি, মেশিন, যন্ত্রপাতির বাজার দরের ওপর জাকাত ফরজ হবে।

একান্নবর্তী পরিবারের জাকাত : আমাদের দেশে অনেক একান্নবর্তী পরিবার রয়েছে। যেসব পরিবারের একাধিক ব্যক্তি উপার্জন ও আয়-রোজগার করেন। সবার উপার্জিত অর্থ-সম্পদ একসঙ্গেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতার হাতে থাকে। প্রত্যেকের কোনো আলাদা মালিকানা বা হিসাব-নিকাশ থাকে না। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান হচ্ছে যদি তাদের অর্থ-সম্পদ এ পরিমাণ হয় যে তা সবার মাঝে বণ্টন করে দিলে প্রত্যেকের ভাগেই নেসাব পরিমাণ সম্পদ আসবে তাহলে তাদের প্রত্যেকেরই জাকাত দিতে হবে। অন্যথায় নয়।

স্ত্রীর মোহরানা ও জাকাত : কারও যদি নেসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকে অপরদিকে এ পরিমাণ ঋণও থাকে যে সে ঋণ বাদ দিলে তার নেসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে না তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে না। যদি ঋণ বাদ দিলেও নেসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বাকি থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। এটাই শরিয়তের বিধান। স্ত্রীর মোহরানাও একটি ঋণ বটে। সে অনুসারে স্ত্রীর মোহরানার টাকা বাদ দিয়ে যদি নেসাব অবশিষ্ট না থাকে তাহলে জাকাত ফরজ না হওয়ারই কথা। যদি মোহরানার টাকা বাদ দিলেও নেসাব বাকি থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পদের ওপরই কেবল জাকাত ফরজ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু বাকি মোহর পরিশোধের ব্যপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়। স্ত্রীরাও তা দাবি করে না। অনেক ক্ষেত্রে মাফই করে দেয়। তাই স্ত্রীর মোহর জাকাতের ফরজ হতে প্রতিবন্ধক হবে না। বা মোহরানার টাকা বাদ দেয়া হবে না। বরং পূর্ণ অর্থ-সম্পদেরই জাকাত দিতে হবে। ফতওয়ায়ে আলমগিরিতে রয়েছে যার দায়িত্বে স্ত্রীর বাকি মোহরানা রয়েছে কিন্তু সে তা (সদ্য) পরিশোধের ইচ্ছা রাখে না তার ক্ষেত্রে সেটা জাকাত ফরজ হতে প্রতিবন্ধক হবে না।

অলংকারের জাকাত : মহিলাদের ব্যবহারের অলংকার নেসাব পরিমাণ হলে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মহিলাদের নেসাব পরিমাণ অলংকার আছে কিন্তু নগদ কোনো অর্থ-কড়ি নেই, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হয় তারা তাদের অলংকারের জাকাত কোত্থেকে আদায় করবে? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে যদি অলংকার বিক্রি করেইও জাকাত দিতে হয় তাহলে তাই করতে হবে, হ্যাঁ স্বামী যদি স্ত্রীর অলংকারের জাকাত নিজে অদায় করে দেয় তাহলে জাকাত অবশ্যই আদায় হবে। যেহেতু জাকাত দিতেই হবে সেহেতু মহিলারা তাদের স্বর্ণালংকারের জাকাতের জন্য সারা বছর সামান্য সামান্য টাকা জমা করে রাখতে পারেন।