ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ প্রসঙ্গে ৩টি প্রশ্ন ও উত্তর

ফজরের নামাজের সুন্নত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ফজরের সুন্নত ছেড়ে দিয়ো না। যদিও সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে তাড়া দেয়।’ -মুসনাদে আহমদ

এই দুই রাকাত নামাজ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে থাকি।  এখানে মাসিক আল কাউসারের সৌজন্যে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ নিয়ে তিনটি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর তুলে ধরা হয়েছে।

১. প্রশ্ন: ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ ঘরে পড়া সুন্নত, না মসজিদে পড়া সুন্নত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করতেন? মসজিদে পড়ার কোনো প্রমাণ আছে কি? অনুগ্রহপূর্বক উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: ফজরের সুন্নতসহ সকল সুন্নত ও নফল নামাজ ঘরে আদায় করা উত্তম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, … তোমরা ঘরে নামাজ আদায় কর। কেননা ফরজ নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাজ ঘরে আদায় করাই উত্তম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৭৮১

আর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সুন্নত সাধারণত ঘরেই আদায় করতেন।

আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সুন্নত আদায় করে প্রয়োজন হলে আমার সাথে কথা বলতেন। অন্যথায় ফরজ আদায় করার জন্য মসজিদে চলে যেতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ৪১৮

অবশ্য সাহাবা ও তাবেঈন থেকে ফজরের সুন্নত মসজিদে আদায় করাও প্রমাণিত আছে। তাই মসজিদেও সুন্নত আদায় করা যাবে।

এক বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এমন সময় মসজিদে প্রবেশ করলেন যখন ইমাম নামায পড়াচ্ছিলেন। তিনি (প্রথমে) ফজরের দু’ রাকাত সুন্নত আদায় করলেন। -শরহু মাআনিল আছার ১/২৫৫

আবু উসমান আনসারী রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. মসজিদে এমন সময় এলেন যখন ইমাম ফজরের নামাজ পড়াচ্ছেন। আর তিনি তখনো ফজরের সুন্নত পড়েননি। তিনি প্রথমে পেছনে ফজরের সুন্নত আদায় করলেন। অতপর জামাতে শরিক হলেন। -শরহু মাআনিল আছার ১/২৫৬

অন্য বর্ণনায় আছে, বিশিষ্ট তাবেয়ী সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. মসজিদে এমন সময় এলেন যখন ইমাম ফজর নামাজ পড়াচ্ছেন। তিনি মসজিদের দরজার সামনে সুন্নত পড়লেন অতপর জামাতে শরিক হলেন। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৬৪৭৪; বাযলুল মাজহূদ ৬/৩৭২

 

২. প্রশ্ন: আমার মাঝে মাঝে এমন হয় যে, ফজরের সময় মসজিদে গিয়ে দেখি নামাযের ইকামত হচ্ছে বা জামাত শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় জামাতের কতটুকু অংশ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আমি সুন্নত পড়ব? দ্বিতীয় রাকাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নাকি ইমামকে তাশাহহুদে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে? জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: ফজরের সুন্নত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা ফজরের সুন্নত ছেড়ে দিও না। যদিও সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে তাড়া দেয়।-মুসনাদে আহমদ ২/৪০৫

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস ও আবু দারদা রা.-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবীদের থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা ফজরের জামাত শুরু হয়ে গেলেও সুন্নত পড়ে নিতেন। যেমন আবু দারদা রা. ফজরের সময় মসজিদে প্রবেশ করে লোকজনকে ফজরের জামাতে কাতারবদ্ধ পেলে মসজিদের এক কোণে (ফজরের) সুন্নত পড়তেন। অতপর মানুষের সাথে জামাতে শরিক হতেন। -শরহু মাআনিল আছার, তহাবী ১/২৫৬

সুতরাং ফজরের জামাত শুরু হয়ে গেলেও সুন্নত পড়ে যদি জামাতের সাথে দ্বিতীয় রাকাতও পাওয়া যায় তাহলে সুন্নত পড়ে নিবে। আর দ্বিতীয় রাকাত পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সুন্নত পড়বে না; বরং জামাতে শরিক হয়ে যাবে এবং সূর্যোদয়ের পর তা পড়ে নিবে।

প্রকাশ থাকে যে, কোনো কোনো ফকীহ সুন্নত পড়ার পর ইমামকে তাশাহহুদে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সুন্নত পড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহর মত তা-ই, যা উপরে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, জামাত শুরু হওয়ার পর মসজিদে সুন্নত পড়ার কিছু শর্ত রয়েছে। যথা-

ক. কাতারের সাথে মিলিত হয়ে পড়া যাবে না। মসজিদের বারান্দায় বা কাতার থেকে দূরে মসজিদের এক কোণে বা কোনো পিলারের আড়ালে সুন্নত পড়বে।

খ. জামাত থেকে পিছনে পৃথক হয়ে সুন্নত পড়ার মতো জায়গা না থাকলে সুন্নত পড়া যাবে না। এক্ষেত্রে জামাতে শরিক হয়ে যাবে।

 

৩. প্রশ্ন: আমি একদিন ফজরের নামাজের সময় মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবকে দ্বিতীয় রাকাতে পাই। তখন আমি সুন্নত না পড়েই জামাতে শরিক হয়ে যাই। নামাজ শেষ হওয়ার পরও ফজরের অনেক সময় বাকি ছিল। তাই আমি মসজিদের এক কোণে সুন্নতের জন্য দাঁড়িয়ে যাই। এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, এখন সুন্নত পড়া মাকরূহ। সূর্যোদয়ের পর পড়ে নিও। জানতে চাই, ঐ ব্যক্তির কথাটি কি সঠিক?

উত্তর: হাঁ, ঐ ব্যক্তি ঠিকই বলেছে। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাযের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮২৫

তাই ফজরের সুন্নত ছুটে গেলে সূর্যোদয়ের আগে পড়বে না; বরং সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য হেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আদায় করে নিবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত (সময়মতো) পড়েনি সে যেন সূর্যোদয়ের পর তা আদায় করে নেয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ৪২৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১০৫৩

নাফে রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. (ফজরের সময়) মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন জামাত শুরু হয়ে গেছে। তিনি ফজরের সুন্নত না পড়েই জামাতে শরিক হয়ে গেলেন। নামায শেষে তিনি মসজিদে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। অতপর সূর্যোদয় হয়ে গেলে তিনি দুই রাকাত সুন্নত কাযা করে নেন। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ২/৪৪৩; রদ্দুল মুহতার ২/৫৭; মাআরিফুস সুনান ৪/৮৮