কুরবানি দেবেন, এ বিষয়গুলো কি ভেবে দেখেছেন?

ইসলামি শরিয়তের অন্যতম ইবাদত কুরবানি। তাই কুরবানির আগে অনেক কিছু ভেবে দেখা এবং মেনে চলা জরুরি। কেননা কুরবানির পশুর রক্ত মাংস হাড় বা চামড়া কোনো কিছু মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং কুরবানি দাতার বিশুদ্ধ নিয়ত ও বৈধ ব্যবস্থাপনাই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।

তাই কুরবানির পশু কেনা ও কুরবানি করার আগে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো গুরুত্বসহ ভেবে দেখা জরুরি। আর তাহলো-

গরিব ব্যক্তির কুরবানি ও করণীয়

সামর্থবানদের জন্য কুরবানি আবশ্যক। তবে গরিব লোকের কুরবানি দেয়া নিষেধ নয়। চাইলে গরিবও কুরবানি দিতে পারবে। চাইলে একাকি কুরবানি দিতে পারবে আবার অংশীদারের সঙ্গেও কুরবানি দিতে পারবে। তবে গরিব ব্যক্তি যদি কুরবানির পশু কেনার সময় একাকি কুরবানির নিয়ত করে তাহলে পরে আর শরিক নিতে পারবে না।

তাই গরিবের ক্ষেত্রে কুরবানির পশু কেনার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সে একাকি কুরবানি করবে না শরিকে নেবে। পশু কেনার আগে শরিক নেয়া নিয়ত না থাকলে, পশু কেনার পরে শরিক নিতে পারবে না।

পক্ষান্তরে কোনো ধনী যদি পশু কেনার আগে শরিক নেয়ার নিয়ত না করে তবে ধনী ইচ্ছা করলে পশু কেনার পরও শরিক নিতে পারবে।

শরিক নেয়ার আগে ভেবে দেখুন

কুরবানি অনেক ফজিলতপূর্ণ মর্যাদার ইবাদত। কয়েকজন মিলে কুরবানি দিতে চাইলে ভেবে দেখুন, অংশীদারের সমন্বয়ে যারা কুরবানি দেবেন। তাদের পশু কেনার অর্থ বৈধ কিনা অবৈধ।

কোনো ব্যক্তির সব কিংবা আংশিক উপার্জনও যদি হারাম হয়, তবে ওই ব্যক্তিকে কুরবানির পশুর অংশীদার হিসেবে নিলে আর হারাম উপার্জনের অংশ দিয়ে কুরবানির পশু কিনলে অন্যদের হালাল পয়সার কেনা পশুর কুরবানিও নষ্ট হয়ে যাবে।

অংশীদার নির্বাচন

পশু কেনার আগেই অংশীদার নির্বাচন করে নিন। ওয়াজিব কুরবানি আদায়ের নিয়তে এক গরু কিংবা মহিষে ৭ জন কুরবানি দিতে পারবে। তাছাড়া এর মধ্যে যদি কেউ নফল কুরবানিও দেয় তাতেও ৭ জনের বেশি শরিক নেয়া যাবে না। তবে ছাগল, বকরি বা দুম্বায় অংশীদার নয় বরং তা একাকি কুরবানি করতে হয়।

ঋণ করে কি কুরবানি করা যায়?

যদি কোনো ব্যক্তির উপর কুরবানি আবশ্যক হয়। আর তার পশু কেনার মতো কাছে নগদ অর্থ না থাকে তবে সে সম্পদ বিক্রি করবে। আর যদি সম্পদ বিক্রি করতেও না চায় তবে সে ঋণ করে হলেও কুরবানি করবে। যেমনিভাবে সে অন্যান্য প্রয়োজন পূরণে ঋণ করে থাকে। যা পরবর্তীতে পরিশোধ করে দেবে।

কুরবানি করার আগে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এর ব্যতয় ঘটলে কারো কুরবানিই বৈধ হবে না।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরবানির পশু কেনার আগে কিংবা কুরবানির নির্ধারিত দিনগুলোর মধ্যে যথাযথ নিয়ম মেনে তা আদায় করার তাওফিক দান করুন। কুরবানির ঘোষিত ফজিলত, সাওয়াব ও মর্যাদা লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

কুরবানির যে বিষয়গুলো জেনে নেয়া জরুরি

কুরআনের বর্ণনায় কুরবানি আল্লাহর জন্য নির্ধারিত একটি মহান ইবাদত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল) আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু শুধুমাত্র বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’

কুরবানির গুরুত্ব জানতে বিশ্বনবির সে হাদিসটিই যথেষ্ট, তিনি বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে।’ (মুসতাদরেকে হাকেম)

কুরআন ও হাদিসের আলোকে কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর তা সামর্থ্যবানদের আদায় করা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি কুরবানি আদায়ে সক্ষম থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করবে না, সে ওয়াজিব তরকে গোনাহগার হবে।

কুরবানির সময়
কুরবানি আদায় করার জন্য নির্ধারিত দিনক্ষণ ঠিক করা রয়েছে। মোট তিনদিন কুরবানি করা যায়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানি করা যায়। তবে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে কুরবানি করাই উত্তম।

যাদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ ৩ দিন যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব।
দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা বা ভরন-পোষণ, খোরাকীর প্রয়োজনে আসে না এমন অতিরিক্ত কিংবা পতিত জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্রসহ অন্যান্য সম্পদ নিসাব হিসেবে গণ্য। আর তা যদি সাড়ে ৭ ভরি সোনা কিংবা সাড়ে ৫২ ভরি রূপার মূল্যের সমান হয় তবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব।
যদি এককভাবে সোনা-রূপা অথবা টাকা নিসাব পরিমাণ না থাকে কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু, সোনা, রূপা ও টাকা একত্রিত করলে সাড়ে ৫২ ভরি রূপা কিংবা সাড়ে ৭ ভরি সোনার দামের সম পরিমাণ হয় তবে ওই ব্যক্তির জন্যও কুরবানি করা আবশ্যক।

যে সব পশুতে কুরবানি করা যাবে
যেসব পশু দিয়ে কুরবানি করা যাবে তাহলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। তবে এসব পশু হতে হবে গৃহপালিত। তবে হরিণ কিংবা বন্য পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে না।

পশুর বয়স
যেসব পশুতে কুরবানি করা যাবে, তার জন্য রয়েছে সর্বনিম্ন নির্ধারিত বয়স। আর তাহলো-

> উট : ৫ বছরের হতে হবে।
> গরু ও মহিষ : ২ বছরের হতে হবে।
> ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা : কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে।
তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু দেখতে এমন সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেখা যায় যে, ১ বছরের মতো মনে হয় তবে তা দ্বারাও কুরবানি করা যাবে। তা কোনোভাবেই ৬ মাসের কম হলে চলবে না।
আর ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে তা দ্বারা কোনো অবস্থাতেই কুরবানি করা যাবে না।’

পশুতে অংশীদার

> উট, গরু, মহিষ : সর্বোচ্চ ৭ মিলে একটি পশু কুরবানি দিতে পারবে। এর বেশি নয়। তবে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য কুরবানির জন্য এককভাবে কুরবানি দেয়ার বিকল্প নেই।
> ছাগল, ভেড়া ও দুম্বারে ক্ষেত্রে একাধিক ভাগে কুরবানি দিলে হবে না। তা এককভাবে আদায় করতে হবে।

যে পশুতে কুরবানি নয়
গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দিয়ে কুরবানি করতে হয়। আর তা দেখতে সুন্দর, সুস্থ ও সুঠাম দেহের অধিকারী হলে আরো উত্তম। তবে যে পশু দিয়ে কুরবানি বৈধ নয়। তাহলো-
– কুরবানির স্থানে হেটে যেতে পারবে না এমন পশু দিয়ে কুরবানি করা বৈধ নয়।
-কোনো পশুর যদি দাঁত না থাকার কারণে খাবার গ্রহণ করতে না পারে তবে তা দ্বারাও কুরবানি বৈধ নয়।
– গোড়া থেকে ভাঙা শিং-এর গরু যদি মস্তিষ্কে আঘাত পায় তবে তা দ্বারাও কুরবানি বৈধ হবে না।
– কুরবানির পশুর কান বা লেজ যদি অর্ধেকের বেশি কাটা থাকে তা দিয়েও কুরবানি বৈধ নয়।

অসিয়তের কুরবানি
কোনো ব্যক্তি যদি তার পক্ষ থেকে কুরবানির অসিয়ত করে আর টাকা পয়সা থাকে তবে তার কুরবানি আদায় করা ওয়াজিব। অসিয়তকারী যদি মৃতব্যক্তিও হয় তবে তার কুরবানি আদায় করাও আবশ্যক। তবে মৃতব্যক্তির অসিয়তের কুরবানির গোশত ওয়ারিশরা খেতে পারবে না। গরিব-অসহায়দের দান করে দিতে হবে।
আর মৃতব্যক্তির অসিয়ত না থাকলে যদি ওয়ারিশ মৃতব্যক্তির নামে কুরবানি দেয় তবে তা নফল কুরবানি হিসেবে পরিগণিত হবে। আর তার গোশত নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনরাও খেতে পারবে।

অন্য ব্যক্তির কুরবানি
কোনো ব্যক্তির ওপর যদি কুরবানি ওয়াজিব হয়। কিন্তু কুরবানি দেয়ার কোনো অনুমতি না থাকে তবে ওই ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিত অন্য কেউ কুরবানি দিলে তা আদায় হবে না। অবশ্যই সে ব্যক্তির কুরবানি করতে হলে অনুমতি নিতে হবে।
আর যদি কোনো স্বামী বা পিতা তার স্ত্রী কিংবা সন্তানের অনুমতি না নিয়ে তাদের নামে কুরবানি দেয় তবে তা আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে কুরবানি আদায় করা উত্তম।

কুরবানির হাড়, গোশত ও চর্বি বিক্রি
যে বা যারা কুরবানি আদায় করবে, তাদের জন্য এ কুরবানির পশুর হাড়, গোশত ও চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা বৈধ নয়। যদি কেউ নিজ কুরবানির গোশত বা চর্বি বিক্রি করে তবে এ অর্থ সাদকা করে দিতে হবে। তবে যদি কোনো টোকাই কিংবা অসহায় ব্যক্তি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোশত, হাড় কিংবা চর্বি সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে ওটা তাদের জন্য বৈধ। কুরবানিদাতার জন্য নয়।

কুরবানির পশুর গোশতে থেকে পারিশ্রমিক
কুরবানির পশু থেকে কোনো গোশত কর্মচারি কিংবা কাজের লোককে তাদের পরিশ্রমিক হিসেবে দেয়া যাবে না। গোশত, হাড় কিংবা চর্বি ও চামড়া কোনো কিছুই পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া যাবে না। তবে এসব লোকদেরকে কুরবানির গোশত খাওয়ানো যাবে।

নির্ধারিত দিনে কুরবানি করতে না পারলে
কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারণে ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো কারণে কুরবানির পশু সংগ্রহ করতে না পারে কিংবা কোনো কারণে পশু থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করতে না পারে তবে সে ব্যক্তি কুরবানির পশু না কিনে সে অর্থ গরিব-অসহায়দের সাদকা করে দেবে।
আর যারা পশু ক্রয় করা সত্ত্বেও কুরবানি করতে পারেনি তারা ওই পশু জীবিত সাদকা করে দেবে।

মুসাফিরের জন্য কুরবানি
যে ব্যক্তি কুরবানির দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। তবে কুরবানি থেকে বিরত থাকার নিয়তে কুরবানির সময় সফর করা বৈধ নয়।

গরিব-অসহায়দের কুরবানি
গরিব কিংবা অসহায় ব্যক্তির উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানির নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করে তবে তা কুরবানি করা ওয়াজিব।

কুরবানির দিন কখন কুরবানির সময়
অবশ্যই ঈদের নামাজের পর কুরবানি আদায় করা। যদি কেউ ঈদের নামাজের আগে কুরবানি করে তবে তার কুরবানি পুনরায় আদায় করতে হবে।

কুরবানির উদ্দেশ্যে কেনা পশু দ্বারা উপকার গ্রহণ
কুরবানির উদ্দেশ্যে ক্রয় করা কোনো পশু থেকে উপকার নেয়া যাবে না। যেমন- দুধগ্রহণ করা, হাল-চাষ করা, পরিবহন হিসেবে ব্যবহার করা কিংবা পষম কাটা ইত্যাদি। যদি কেউ একান্তই উপকার গ্রহণ করে তবে সুবিধা গ্রহণ সমমূল্য সাদকা করে দিতে হবে।

ঋণ করে কুরবানি
কুরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণ করে কুরবানি দিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানি করা যাবে না।

কুরবানি আদায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো মেনে চলা সবার জন্যই জরুরি। আর তা মেনে চললে কারো কুরবানিই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ নিয়ম-কানুন মেনে কুরবানি আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।