উপকারী হোন, সফল হবেন

হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব কষ্টসমূহের মধ্যে থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ তার সাহায্য-সহায়তা করতে থাকেন।’ -মুসলিম শরীফ : ২৪৫ (সংক্ষেপিত)

মুসলিম শরীফের উল্লিখিত হাদিসটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এমন কতগুলো কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা জীবন চলার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মাত্র ৪টি কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১. কষ্ট দূর করে দেয়া, ২. অভাব লাঘব করা, ৩. দোষ গোপন করা ও ৪. সাহায্য করা।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ মানুষ এককভাবে বেঁচে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই সমাজের প্রতিটি সদস্যই পরনির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার গুরুত্বকে বিবেচনায় এনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন। আপনি গভীরভাবে চিন্তা করুন, হাদিসে উল্লিখিত চারটি মৌলিক বিষয় যদি কোনো সমাজের সদস্যরা দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে সেখানকার সামাজিক পরিবেশ কি হবে? এই হাদিসটি ওপর আমল করা হলে, আমাদের সমাজের যত হানাহানি, মারামারি, অভাব-অনটন ও সামাজিক অস্থিরতা বহুলাংশে কমে যাবে- ইনশাআল্লাহ।

দুঃখের সাথে বলতে হয়, উল্লেখিত বিষয়াদীয় বিপরীত সব কর্মকাণ্ডই আমরা দেখে থাকি। একটু ক্ষমতাশীল হলে নিজেকে সমাজের অপ্রতিরোধ্য মনে করা। মানুষের কষ্ট দূর করার পরিবর্তে অন্যকে কষ্টে ফেলা। এমনকি মানুষের কষ্ট দেখে খুশি হওয়া। এসবই অমানবিক কাজ। ক্ষেত্রবিশেষ এমনও দেখা যায় যে, অনেকেই অধীনস্থদের ইচ্ছা করে কষ্ট দেন। কোনো কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কোনো দায়িত্ব পাওয়ার পর তার মানবিক মূল্যবোধের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। তার বিনম্র মুখাবয়বটি শক্তরূপ ধারণ করে। সে একটুও চিন্তা করে না- তার ওপরে মহাশক্তিধর একজন আছেন, যিনি তাকে এখানে বসিয়েছেন। যে কোনো সময় তারও মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আছড়ে পড়তে পারে।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি একজন ভৃত্যকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলাম। এ সময় আমার পশ্চাতে একটা শব্দ শুনলাম, ‘জেনে রেখো, হে আবু মাসউদ! আল্লাহতায়ালাই তোমাকে এ ভৃত্যের ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন।’ আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আর কখনো দাস-দাসী ও চাকর-চাকরানীকে প্রহার করবো না। আমি ওকে স্বাধীন করে দিলাম। রাসূলে কারিম (সা.) বললেন, এ কাজটি না করলে আগুন তোমাকে কিয়ামতের দিন ভস্মীভূত করে দিতভ।’ –সহিহ মুসলিম

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন অসহায়, দুর্বল ও নির্যাতিতদের বিশ্বস্ত অভিভাবক, অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীল ও প্রতিবেশীদের আপনজন। জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি তাদের কথা ভুলেননি। এদের কথা বলে বলে পৃথিবীবাসীকে বারবার সাবধান করে গেছেন। বলেছেন, ‘নামাজ ও অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’- আবু দাউদ

ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণেও তিনি অধীনস্থ ও দুর্বলদের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার সৌভাগ্যের উৎস আর তাদের সাথে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যের উৎস।’ -আবু দাউদ

মানুষের ক্ষতি করা, মানুষকে কষ্ট দেয়া খুবই সহজ কাজ। তাই বলে মানুষের একটি কষ্ট দূর করা বা তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যে খুবই কঠিন তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন শুধু একটু সদিচ্ছা আর আল্লাহকে ভয় করা ও রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা।

যারা জেনে-বুঝে মানুষকে কষ্ট দেয়, তাদের ঈমান নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ধরনের চরিত্র ও ঈমান পাশাপাশি একসাথে চলতে পারে না। মানুষের ক্ষতি করা ও তাদেরকে কষ্ট দেয়া কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি আল্লাহর রাসূল (সা.) এ ধরনের লোককে মুসলিম বলতেও নারাজ। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি মুসলিম যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকেন।’

সুতরাং কোনো মুসলিম অন্য কোনো মুসলিমকে কষ্ট দিতে পারেন না। যদি কষ্ট দেন তবে তিনি অমুসলিম হিসেবে চিহ্নিত হবেন। আর এটি জুলুমও বটে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) জুলুম সম্পর্কে কঠিন কঠিন বাক্য প্রয়োগ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।’-সূরা শুরা : ২২৭

জনৈক আরব কবি বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করো না, জুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। জুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও, কিন্তু মজলুমের চোখে ঘুম আসে না। সে সারা রাত তোমার জন্য বদ দোয়া করে এবং আল্লাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না।’

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা জালেমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, ‘তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদসমূহকে পাকড়াও করেন, তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।’ –বোখারি ও মুসলিম

সুতরাং আসুন, আমরা পরস্পরে অনে অন্যের একটি করে কষ্ট লাঘব করি, উপকার করি, সহযোগিতার হাত বাড়াই; কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা আমাদের বড় বড় কষ্টসমূহ দূর করে দিবেন- ইনশাআল্লাহ।